SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব | NCTB BOOK

কোম্পানির শাসন দুর্নীতিমুক্ত ও সুসংগঠিত করতে ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসকে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ঐ বছর ২২শে মার্চ নির্দিষ্ট রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারদের নিজ নিজ জমির ওপর স্থায়ী মালিকানা দান করে যে বন্দোবস্ত চালু করা হয়, তাকেই 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলা হয়।

 

পটভূমি :

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালা বন্দোবস্ত চালু করেন । এই ব্যবস্থায় উচ্চহারে ডাক নিয়ে জমির বন্দোবস্ত নিলেও সেই অনুপাতে রাজস্ব আদায় হতো না । নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকায় জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করত । অথচ কৃষকদের উন্নয়ন বা জমির উন্নয়নের প্রতি তাদের কোনো লক্ষ ছিল না। ফলে নির্যাতনের ভয়ে কৃষকরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেত । বছরের পর বছর জমি অনাবাদি থাকায় জমির দাম কমে যেত। এ অবস্থায় হেস্টিংস জমিদারদের সঙ্গে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। কিন্তু, এ ব্যবস্থায়ও সরকার, জমিদার, প্রজা- কারো কোনো ধরনের উপকার হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ।

১৭৮৪ সালে পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পার্লামেন্টে গৃহীত হয় ৷ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় স্থায়ী নিয়ম-কানুন প্রবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭৮৯ সালে কর্নওয়ালিস জমিদারদের দশসালা বন্দোবস্ত দিতে প্রস্তুতি নেন । ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্তের অনুমতি প্রদান করলে কর্নওয়ালিস এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৯ সালে দশসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। তবে এর সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন যে, কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন পেলে দশসালা বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হবে। ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই দশসালা বন্দোবস্ত বোর্ড অব ডাইরেক্টরস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ কর্নওয়ালিস দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করেন ।

 

বৈশিষ্ট্য:

  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের জমির স্থায়ী মালিকে পরিণত করে এবং জমিদাররা জমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করে ।
  • রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে জমিদার জমিদারি ভোগের চিরস্থায়ী অধিকার লাভ করে ।
  • এ প্রথা চালু হওয়ার ফলে জমিদারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় । সরকার স্বয়ং শান্তি রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে ।
  • খাজনা বাকি পড়লে জমিদারদের ভূমির কিছু অংশ বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা ছিল ।

 

ফলাফল:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে । কর্নওয়ালিস জমিদার ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের মতো এদেশেও একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ইউরোপ আর উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও তার বিকাশের ধরন এক ছিল না । ফলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া এ ব্যবস্থায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই অধিক পরিলক্ষিত হয়।

 

সুবিধা:

  • এ ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হচ্ছে সরকার তার আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয় । যে কারণে বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয় ।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি কোম্পানির একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠে । ফলে, ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়করণ এবং দীর্ঘায়িতকরণে জমিদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় ।
  • জমির ওপর জমিদারের স্থায়ী মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার কারণে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় নানা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হয়। জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষের ব্যবস্থা করে । ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় ।

 

ত্রুটি:

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের স্বার্থ সুরক্ষিত হয় । তারা ধীরে ধীরে ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয় । অপর দিকে জমিতে প্রজাদের পুরোনো স্বত্ত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। ফলে জমিদার ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত । প্রথম দিকে প্রজাস্বত্ব আইন না থাকায় তাদের ভাগ্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে জমিদারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো ।

  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমির সঠিক জরিপের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নিষ্কর জমির ওপর বেশি রাজস্ব ধার্য করা হতো । জমির সীমা নির্ধারিত না থাকায় পরবর্তীকালে মামলা বিবাদও দেখা দিত ।
  • সূর্যাস্ত আইনে নির্দিষ্ট তারিখে সূর্যাস্তের মধ্যে খাজনা পরিশোধ বিধানের কঠোরতার কারণে অনেক বড় বড় জমিদারি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ।
  • জমিদারি আয় ও স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে জমিদাররা নায়েব-গোমস্তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে শহরে বসবাস শুরু করে। এসব অনুপস্থিত জমিদারদের নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । ফলে জমির উৎপাদন কমে যেতে থাকে, গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে ।
  • উপমহাদেশে জমি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক । ফলে নিম্নবর্গের অনেক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ যারা কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হন, তারা জমিদারি কিনে আভিজাত্যের মর্যাদা লাভে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে দেশীয় পুঁজি, দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায় । অপর দিকে কোম্পানিও সম্ভাব্য এদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে বেঁচে যায় ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা সরাসরি জমিদার কর্তৃক শোষিত হতে থাকে । আবার এই জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে গ্রামীণ সমাজে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছিল, যারা পরবর্তী সময়ে দেশ-জাতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি যারা প্রথমদিকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের শক্ত ভিত ছিল, তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ-রাজ উৎখাতের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । উপমহাদেশে জাতীয়বাদ বিকশিত এভাবেই হয়।

Content added || updated By